পটুয়াখালীর বাউফলের আকাশে আজ এক বিষণ্ণ মেঘের ছায়া। এক কিশোরীর স্বপ্নভঙ্গ, এক মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, আর সমাজের বুকে এক গভীর ক্ষত। চিরকুট লিখে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে এক স্কুলছাত্রী, বয়স আনুমানিক ১৫ বছর। পরিবারের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছিল সে।
মেয়েটি যখন স্কুলে যেত, একদল বখাটে যুবক তাকে উত্ত্যক্ত করত। অশ্লীল মন্তব্য, ইশারা-ইঙ্গিত, এমনকি শারীরিক নিগ্রহের চেষ্টাও করা হয়। ভয়ে প্রথমে পরিবারকে কিছু জানায়নি সে। কিন্তু উত্ত্যক্তের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায়, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে কিশোরীটি।
“আত্মহত্যার আগে আমার মেয়ে চিরকুটে লিখে গেছেন। চিরকুটে আত্মহত্যার জন্য ওই ছেলেকে দায়ী করে গেছে।“
পরিবারের অভিযোগ, মেয়েটি কয়েকবার তাদের কাছে উত্ত্যক্তের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয়ভাবে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। বখাটেদের উৎপাত বরং আরও বেড়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত, আর সহ্য করতে না পেরে, মেয়েটি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে সে। পরে পরিবারের লোকজন দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তার ঝুলন্ত দেহ দেখতে পায়।
পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে একটি চিরকুট উদ্ধার করেছে। সেখানে লেখা ছিল, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না।” এই কয়েকটি শব্দই বলে দেয়, মেয়েটি কতটা অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল হোসেন বলেন, “খবর পেয়ে তিনিসহ পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছেন। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনা হবে।” তিনি আরো বলেন, “একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে।” পুলিশ জানায়, “বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ওই কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। প্রথমে পরিবার নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্ত করাতে চায়নি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ নিহত শিক্ষার্থীর বাড়িতে যায় এবং মরদেহ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্তের জন্য পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।”
নিহত ছাত্রীর বাবা নজরুল ইসলাম খান বলেন, “আত্মহত্যার আগে আমার মেয়ে চিরকুটে লিখে গেছে। চিরকুটে আত্মহত্যার জন্য ওই ছেলেকে দায়ী করে গেছে। তাঁর মেয়েকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি ওই বখাটের ফাঁসি চান।” ছাত্রীর মা অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়ে অত্যন্ত ভদ্র ও লাজুক। তাকে বিভিন্ন সময় ছেলেটি কুপ্রস্তাব দিয়ে আসছিল। বিষয়টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ওই বখাটের পরিবারকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গতকাল তাঁর মেয়ের সঙ্গে তার এক সহপাঠির তোলা স্বাভাবিক ছবিতে বাজে মন্তব্য লিখে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয় ওই বখাটে। এতে লোকলজ্জার ভয়ে তাঁর মেয়ে আত্মহত্যা করে। তিনি এই হত্যার বিচার চান। নিহত ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ,
“দীর্ঘদিন ধরেই স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে কুমকুমকে উত্যক্ত করতো একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াদুল ইসলাম তাওসিন। বিষয়টি তাওসিনের চাচা ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানায় ভুক্তভোগীর পরিবার। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কুমকুম ও তার আরেক সহপাঠী কিশোরের একসাথে তোলা ছবির সাথে নোংরা মন্তব্য লিখে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয় তাওসিন। বিষয়টি জানার পর চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করে কুমকুম।”
বাউফলের এই ঘটনা আমাদের সমাজের এক নির্মম চিত্র তুলে ধরে। যেখানে কিশোরীরা প্রতিনিয়ত উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, তারা ন্যায়বিচার পায় না। প্রশ্ন জাগে, আর কত প্রাণ ঝরলে আমাদের ঘুম ভাঙবে? আর কত কিশোরী নিজেদের শেষ করে দিলে আমরা বুঝবো, সমাজটা কতটা পচে গেছে?