গত ২০ মার্চ ২০২৫ এ, পুরান ঢাকার লালবাগে ঘটে গেছে একটি মর্মান্তিক ঘটনা। নিজের বিয়ে করা স্ত্রীকে স্বীকৃতি দেয়ার ভয়ে এবং অন্যান্য মেয়েদের সাথে পরকীয়ার জের ধরে খুনী কাজী সাগর (বয়স ২৫ বছর) খুন করেছে তাহিয়া তাসনীম ফিমা ( বয়স ২০ বছর) নামক তরুণীকে। ফিমা-র নিজ বাসগৃহে একা বাসায় পেয়ে সাগর এবং তার সহযোগী আমীন এই হত্যাকান্ড করে বলে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
এই হত্যাকান্ডটি হুট করে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নয়। বরং খুনী হিসেবে অভিযুক্ত সাগরের অনেক দিনের পরিকল্পনার ফসল এই হত্যা। আর তাই আমাদের প্রাইম বিট টিম কথা বলেছে, ফিমা-র বাবা এবং মায়ের সাথে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেলো ভয়ংকর এবং রোমহর্ষক কিছু তথ্য।

ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০২৩ সালে। ফিমা-র সাথে সাগরের পরিচয় হয় এবং তারা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের প্রেমের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে থাকে। কিছুদিনের মাঝেই ফিমা-র মা রীনা ইয়াসমিন এই ব্যাপারে অবগত হন এবং মেয়েকে এই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বারণ করেন। পরবর্তীতে মেয়ের প্রেমকে ফিমা-র পরিবার মেনে নেয় এবং তাদেরকে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে বলে।
কিন্তু সাগরের মনে ভিন্ন কিছু ছিলো। সাগর নিয়মিত জিম করে, দেখতে ফর্সা এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারি। তার রূপ নিয়ে তার গর্ব এবং অহংকার ছিলো। এই ভালো চেহারার পিছনে যে শয়তান লুকিয়ে ছিলো, তা ফিমা এবং তার পরিবারের অগোচরে ছিল।

২০২৪ সালে সাগরের প্ররোচনায় পরিবারের অগোচরে বিয়ে করে ফিমা এবং সাগর। ফিমা-র পরিবার যখন এই বিয়ের ব্যাপারটা জানতে পারেন, তখন তাদের কিছুই করার ছিলো না। যদিও আইনতঃ তারা অপরাধ করেননি, কিন্তু সামাজিকভাবে মা-বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করাকে অপরাধ হিসেবেই ধরা হয়।
মেয়ের সুখের দিকে তাকিয়ে এবং সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে তারা মেয়ের এই অপরাধ মেনে নেন।

ঘটনা এরপরই মোড় নিতে থাকে। ফিমা-র পরিবার থেকে সাগরের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। অবশেষে সাগর ফ্যামিলির কাছে ফিমা-কে উপস্থাপন করতে রাজী হয়। তবে সে কিছুদিন সময় চেয়ে নেয়। মেয়ের মা-বাবা, সাগরের মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে বিভিন্ন বাহানায় সাগর এড়িয়ে যেতে থাকে। এরপর একদিন জোরাজুরিতে সাগর তার বাবার সাথে ফিমার বাবার ফোনে কথা বলিয়ে দেয়। এরপর কয়েকদফা বেয়াইদের মধ্যে কথা হয়। সাগরের বাবা, কিছুদিন সময় চেয়ে নেন।
এরমধ্যেই সাগরের আসল রূপ প্রকাশিত হতে থাকে। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সাগর প্রায়শই ফিমা-র বাসায় আসতো এবং এটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল পরিবার। কিন্তু বিপত্তি হয় তখন, যখন সবাই জানতে পারে, সাগরের এই বিয়ে প্রথম নয়, ৬-৭ বছর আগে থেকেই সে বিবাহিত!
ফিমা-র পরিবারে নেমে আসে কালো ছায়া। শুরু হয় ঝগড়া এবং কথা কাটাকাটি। একপর্যায়ে সাগর বলে যে, আগের বউয়ের সাথে তার বনিবনা হয় না। তাই তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। এতে করে সাময়িক স্বান্ত্বনা পেলেও, কাঁটা হয়ে মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে। এই কাঁটা যে একদিন, মৃত্যুর কারণ হবে, তা টিনেজ ফিমা-র মাথায় ঘুণাক্ষরেও আসেনি।
আস্তে আস্তে সাগরের আরো নাটক সামনে আসতে থাকে। তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের ফাঁদে পড়ে আরো বেশ কিছু তরুণী।
সাগরের আসল বাবা-র ভাষ্যমতে, প্রথম বউ অনেক ভালো মেয়ে। কিন্তু সাগর তার সাথে সংসার করতে পারছে না।
কিন্তু ‘আসল বাবা’ শব্দটা শুনে খটকা লাগে। সাগরের আসল বাবা আর নকল বাবা কী?

কাজী সাগরের আসল বাবা হলেন কাজী মনিরুল হক (বয়স ৪৬ বছর)। তিনি ফরিদপুর আলফাডাঙ্গা-র সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের সাথে রাজনীতি করতেন। তার রয়েছে স্বর্ণ এবং জুয়েলারির বিজনেস। একাধিক শোরুম রয়েছে গহনা বিক্রির। প্রভাব এবং প্রতিপত্তি কোন কিছুতেই কমতি নেই। কিন্তু ২৪ এর সরকার পতনের পর, তার প্রভাবে ভাটা পড়েছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে, তার ছেলে কাজী সাগর, পুরাতন রূপ থেকে আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আগে তাদের পাওয়ার ছিল, এখন তা কমে গেছে। কিন্তু রক্তের যে শয়তান লুকিয়ে ছিল, তা আরও শানিত হয়েছে।
আর কাজী সাগরের নকল বাবা? তার আসল নাম পাওয়া যায় নি। সাগর এবং ফিমার বিয়ের পর পর সাগর তার নকল বাবার সাথে ফিমা-র পরিবারের সাথে কথা বলায় সাগর। সে-ই বাবা, ফিমাদেরকে আশ্বস্ত করে যে, নতুন বউকে তারা মেনে নিবে। অর্থাৎ, সাগর এখানে একটি নাটক করে, যেন মনে হয়, পরিবারের সম্মতি রয়েছে। কিন্তু তা আসলে ছিলোই না। আর এই সত্য প্রকাশিত হয়, যখন মেয়ের ফ্যামিলি থেকে জোরাজুরি করার পর তারা নিজেরাই সাগরের বাবার দোকান থেকে মিটিং এর ব্যবস্থা করে। সেসময় ফিমা-র বাবা তাজুল ইসলাম, কাজী মনিরুল হককে জিজ্ঞেস করেন যে, আগে কখনও কথা হয়েছে কীনা? জবাব কাজী মনির জানান, তাদের এই প্রথম কথা হচ্ছে। সাগরের নাটক ধরা পড়ে যায়।

আস্তে আস্তে সাগরের আরো নাটক সামনে আসতে থাকে। তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের ফাঁদে পড়ে আরো বেশ কিছু তরুণী। তাদের সাথে সম্পর্ক ধরা পড়ে যায় ফিমা-র কাছে। একে তো দুই বিয়ের ঝামেলা, তার উপর পরকীয়া, ১৯ পেরুনো ফিমা-র জীবন যেন তছনছ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ফিমা।
এরমধ্যে একদিন হঠাৎ কোন এক ইস্যুতে ফিমা-র বাসায় এসে ফিমাকে মেরে রক্তাক্ত করে সাগর। ফিমার বাবা তাজুল ইসলাম তখন বাসায় ছিলেন না। ফিমার কিছু বান্ধুবি আর মা ছিলো। বাসায় এসে মেয়েকে রক্তাক্ত দেখে সাথে সাথে সাগরের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি। পারিবারিক সমাঝোতায় মিট্মাট হয় বিষয়টি। কিন্তু, এখন মনে প্রশ্ন জাগে, ওইদিনই কি সাগর ফিমা-কে হত্যা করার টিজার দিয়ে রেখেছিল?
এসব ঘটনার পর সাগরের বাসায় আসা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৫ এর জানুয়ারি মাস থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় সাগরের সাথে। সাগর এই সময়টা নিজেকে মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন নাটক এবং মিউজিক ভিডিওতে শ্যুটিং করে বলে জানা যায়। এবং আরো অনেক মেয়ের সাথে তার সম্পর্কের প্রমাণ হাতে আসে।
মাত্র ২৫ মিনিট? আর এতেই পুলিশের ধারণা হয়, খুনের সম্পূর্ণ প্ল্যান নিয়েই এসেছিল সাগর।
এরপর শুরু হয় অন্যরকম অত্যাচার। সাগর বাসায় এসে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং মোবাইলে ব্লক পেয়ে, সাগর হাত করে নেয় ফিমা-র বাসার দারোয়ানকে (আনুমানিক ৫০বছর)। ফিমা-র সাথে সাগরের দূরত্বের কথা দারোয়ান জানতো না। আর এই সুযোগ ব্যবহার করে, সাগর হত্যার দিন চলে আসে। শোনা গিয়েছে, আগেও (যখন সাগর নিয়মিত যাতায়াত করতো) এই দারোয়ান সাগরকে সাহায্য করতো। বিনিময়ে মিলতো পাঁচশো হাজারের নোট। বাসায় কে এলো, কে গেলো সে ব্যাপারে সব আপডেট দিতো এই দারোয়ান।
ঘটনার দিন ২০ মার্চ, ২০২৫। সাগরের মা সন্ধ্যায় কাজে বেরিয়ে যান, বাবা চলে যান তারাবিহ নামাজে। তার আগেই বাসার আশেপাশে ওঁত পেতে ছিল সাগর এবং তার সঙ্গী আমীন (সাগরের বয়সী)। সবাই বেরিয়ে যেতেই দারোয়ানকে নিয়ে উপরে চলে যায় সাগর এবং আমীন। দারোয়ানকে দেখিয়ে দরজা খুলে জোর করে ঢুকে যায় দুজন। তাদেরকে ঘরে ঢুকিয়ে নিচে চলে যায় দারোয়ান। দারোয়ানের ভাষ্যমতে, সাগর তাকে বলেছিলো, জামাই বউয়ের ঝগড়া হয়েছে, তাই ফিমা দরজা খুলছে না। দারোয়ান তাই ‘উপকার’ করতে গিয়েছিল। মূলতঃ দারোয়ানের এই সাহায্য ছাড়া কোনভাবেই ফিমা-কে খুন করা সম্ভব ছিলো না।
এরপর মাত্র ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে তারা দুজন বেরিয়ে যায়। বাবা তাজুল ইসলাম এবং মা রীনা ইয়াসমিন বাসায় ফিরে দেখেন, ফিমা-র দরজা লক করা। অনেক ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে একপর্যায়ে তারা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখেন মেঝেতে পড়ে আছে ফিমা-র মৃতদেহ। ফ্যানের সাথে ঝুলছে টুকরো কাপড়, মেঝেতে ফিমা। তার নাক ফেটে গিয়েছে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।
কী হয়েছিল সেই ২০-২৫ মিনিটে? পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনের সাথে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, সেই পুরোটা সময় ফিমার ফ্ল্যাটে ধস্তাধস্তি এবং হুলোস্থুলের আওয়াজ পেয়েছেন তারা। তবে, হয়তো ঠিক হয়ে যাবে কিংবা ফ্যামিলি ঝামেলা ভেবে, কেউই এগিয়ে যান নি। কিছুক্ষণ পর সবকিছু থেমে গেলে, তারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কিন্তু এই স্বস্তির নিঃশ্বাসের ফাঁকে বন্ধ হয়ে গেছে পরিবারের চোখের মণি তাহিয়া তাসনীম ফিমা এর দম। মৃত্যুর টানে অনিচ্ছ্বায়, অবহেলায় চলে গেছে না ফেরার দেশে।

মাত্র ২৫ মিনিট? আর এতেই পুলিশের ধারণা হয়, খুনের সম্পূর্ণ প্ল্যান নিয়েই এসেছিল সাগর। আর তাই খুব বেশি সময় নেয়নি তারা। উপর্যুপরি আঘাত করে দ্রুতই শেষ করেছে ফিমা-কে। এরপর আগের বউসহ পরিবারের সবাই লাপাত্তা হয়ে গেছে।
তদন্ত এখনো চলমান। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভারতে কাজী সাগর এবং কাজী মনির ধরা পড়েছে। তাদেরকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।

কী দোষ ছিল ফিমা-র? সে তো শান্ত একটি মেয়ে ছিল। কখনো কারো ক্ষতি করেনি। শুধু চেয়েছিল একটু বেঁচে থাকার অধিকার। ক্ষমতা এবং টাকার কাছে তার জীবন হারিয়েছে, এখন কি ন্যায্য বিচারটুকুও সে পাবে না? নাকি আবার আইন বলবে, ‘আইন অন্ধ’ আর সেই সুযোগে সিঁধ কেটে বেড়িয়ে যাবে সাগর, আমীন এবং মনিরের মত বর্বর পশুরা? সময় এর উত্তর দিবে। আর আমরা থাকবো অপেক্ষায়।
অপেক্ষার খাতায় যোগ হলো আর একটি নতুন নাম – তাহিয়া তাসনীম ফিমা।
ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন এখানে
আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন এখানে