বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে লুকিয়ে থাকা এক ভয়াবহ আর্থিক কেলেঙ্কারির চিত্র উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) চলমান তদন্তে। বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে।
এ তালিকায় প্রথমেই নাম রয়েছে এস আলম গ্রুপের। আর দ্বিতীয় নামটি বেক্সিমকোর। এ প্রক্রিয়ায় আরও রয়েছে নাবিল গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, আরামিট গ্রুপ ও সিকদার গ্রুপ।
ঋণের একটি অংশ নেওয়া হয়েছে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে আমদানির নামে। ঋণ নিতে ব্যাংক কর্মকর্তারা গ্রুপগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে। ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সেগুলো এখন আদায় না হওয়ায় খেলাপি হচ্ছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে লুটপাটের বিষয়ে চলমান ভুয়া বা অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে নেওয়া কোনো ঋণকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউ বেনামি হিসাবে রাখছে না। সেগুলোর সুবিধাভোগীদের বের করে ঋণের দায় তাদের নামে দেখানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিচ্ছে। কয়েকটি গ্রুপ বেশকিছু বেনামি ঋণের দায় স্বীকার করে নিয়েছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো, নাবিলসহ আরও দুটি গ্রুপের নাম রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি বেনামি ঋণ নিয়েছে সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বলে পরিচিত এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল ইসলাম মাসুদ। তার বেনামি ঋণ ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ বেনামি ঋণ নিয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপ বেনামে ঋণ নিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার বেনামে ঋণ নিয়েছেন দেড় হাজার কোটি টাকা। সিকাদার গ্রুপের বেনামি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপের নামে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বেনামি ঋণ রয়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বলে পরিচিত আরও একটি গ্রুপের বেনামি ঋণের ৬০০ কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আরও তদন্ত হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এস আলম গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ২ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকাই নিয়েছে বেনামে। সরাসরি ঋণ ৯৮ হাজার কোটি টাকা এবং পরোক্ষ ঋণ বা বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং উপকরণের (এলসি, ব্যাংক গ্যারান্টি, আগাম চেক প্রদান, রপ্তানি বিল বিক্রি ইত্যাদি) মাধ্যমে নিয়েছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকিং উপকরণের মাধ্যমে নেওয়া ঋণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করায় সেগুলো এখন পরোক্ষ ঋণে পরিণত হচ্ছে। একই সঙ্গে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। যেগুলো পাচার করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রুপের মোট ঋণের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৪৬ শতাংশই নেওয়া হয়েছে বেনামে।
এখন পর্যন্ত তদন্তে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে-বেনামে ১৮৮টি কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ৭৮টি কোম্পানিকে ব্যবহার করেছে। গ্রুপটির নামে মোট ঋণ কত, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত গ্রুপের নামে খেলাপি ঋণের পরিমাণই ৫৩ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। এর মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকা বেনামি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে গ্রুপের মোট ঋণের ৩৭ শতাংশই বেনামে নেওয়া হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপ শুধু নিজস্ব কোম্পানির নামেই ঋণ নিত না। অন্য গ্রুপের কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে তার মূল সুবিধাভোগী ছিল বেক্সিমকো গ্রুপ। এমন নজিরও অনেক পাওয়া গেছে, ঋণের টাকা তোলার আগে হিসাব খোলা হয়েছে। আবার ঋণের টাকা নগদে তোলার পর হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে গ্রুপটি জালিয়াতি করেছে।
এ ধরনের বেশকিছু জালিয়াতির ঘটনা শনাক্ত হওয়ার পর কিছু বেনামি ঋণের দায় গ্রুপটি চিঠি দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছে।
ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন এখানে
আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন এখানে